গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ: সংকট এবং সম্ভাবনা

২০২৪ সাল ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বছরটি সাক্ষী থেকেছে একটি গণঅভ্যুত্থানের। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন দিগন্তের সূচনা করে। সেই অভ্যুত্থান ছিল জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং সুশাসনের জন্য আন্দোলন এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের প্রত্যাশায়। ২০২৫ সাল শুরু হতে যাচ্ছে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আমরা একটি নতুন সূর্যের আলোর নিচে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছি এক সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান হঠাৎ কোনো ঘটনা ছিল না। দীর্ঘদিনের দমনমূলক শাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সুশাসনের অভাবে জনগণের মাঝে হতাশা ও ক্ষোভ জমতে শুরু করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের দুর্বলতা, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থাহীনতা এ ক্ষোভকে আরও জটিল করে তোলে। বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছিল। এর পাশাপাশি ধনী-গরিবের ব্যবধান আরো তীব্র হওয়া জনগণের মধ্যে ন্যায়ের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। বিগত বছরগুলোতে নির্বাচনকালীন অচলাবস্থা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তৈরি সংঘর্ষ পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে। সাধারণ মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ন্যায্য ও স্বচ্ছ রাখতে চাইছিল। কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে এই দাবি বারবার অগ্রাহ্য করা হয়।
যুবসমাজ ছিল ২০২৪ এর আন্দোলনের অন্যতম চালিকাশক্তি। ডিজিটাল যোগাযোগমাধ্যমে একত্রিত হওয়া তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখেছিল একটি দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। তারা জানতো, নৈতিক পরিবর্তন না আনলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শেখ হাসিনার সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো মন্ত্রিসভা পালিয়ে যায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। যার প্রধান লক্ষ্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা এবং দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী বাতিলের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়। প্রশাসন ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। গঠন করা হয় ছয়টি কমিশন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, যা ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি করবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
২০২৫ সাল নতুন প্রত্যাশা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরু হয়েছে। যদিও গণঅভ্যুত্থান সুশাসনের পথ খুলে দিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমে জনসাধারণের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। নতুন সরকার নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে স্বাগত জানিয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। গণঅভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতা কিছুদিনের জন্য বিনিয়োগকারীদের দূরে রেখেছে। এর ফলে বৈদেশিক ঋণের চাপ বাড়ছে এবং রপ্তানি খাতে কিছুটা মন্দা দেখা দিয়েছে।
পুরনো রাজনৈতিক শক্তিগুলো এখনো সক্রিয় এবং তারা নতুন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। তীব্র রাজনৈতিক বিভাজন উন্নয়নের পথে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘকাল ধরে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কারে সময় লাগছে। ফলে জনগণের সেবা প্রদানে অসঙ্গতি রয়ে গেছে।
২০২৫ সালে নতুন সরকারকে সুশাসন ও জনগণের আস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নিতে হবে: দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের গতি বৃদ্ধি, নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে তরুণদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানো, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ এবং দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো শেষ করে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনলেও এর পরিণতিতে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে। ২০২৫ সালের বাংলাদেশ যদি সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারে। তবে এটি একটি সমৃদ্ধ, শক্তিশালী এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে নির্মিত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এজন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি এবং জনগণের একতাবদ্ধ প্রয়াস। বাংলাদেশ নতুন এক স্বপ্নের পথে হাঁটছে—এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। ২০২৫ সাল আমাদের জন্য একটি নতুন আলোর মশাল। গণঅভ্যুত্থানের এই বিজয় আমাদের দেখিয়েছে যে, জনগণের ঐক্য সর্বশক্তির ঊর্ধ্বে। এখন আমাদের দায়িত্ব হলো এই অর্জনকে সঠিকভাবে রক্ষা করা এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি স্বপ্নময় ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ উপহার দেওয়া। ‘নতুন বাংলাদেশ’ কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞা—সমৃদ্ধি, সুশাসন এবং মানবিক মর্যাদার।
স্বাগতম ২০২৫, একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ!
লেখক: মাহবুব তোহা